
কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা ও সমন্বিত প্রজনন শিক্ষা
- Select a language for the TTS:
- Bangla Bangladesh
- Bangla Bangladesh Male
- Bangla India Female
- Bangla India Male
- Language selected: (auto detect) - BN
Play all audios:

কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে একজন সুস্থ মানুষ গড়ে তোলা সম্ভব। এজন্য দরকার কিশোর-কিশোরী-যুবাদের প্রজননস্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দেয়া। নিজের শরীর সম্পর্কে তাদের মনে রয়েছে নানা সংশয়,
ভ্রান্ত ধারণা। এ ভ্রান্ত ধারণা থেকে তারা যাতে বের হয়ে আসতে পারে এজন্য অভিভাবক, শিক্ষক উভয়কেই তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তারা যেন সঠিক সময়ে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা ও তথ্য পায়
সেদিকটাও গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী লিমা (আসল নাম নয়)। পিরিয়ডকালীন সময়ে ওর শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়ায় ভোলার সদর উপজেলার কিশোর-কিশোরী কর্নারে যায় সেবা নিতে। কিন্তু
সেখানে গিয়ে ও দেখতে পায় যারা সেবা দিচ্ছেন তারা সবার সামনেই দেখছেন। তাদের মধ্যে যে কথাবার্তা হচ্ছে তা অন্যরাও জেনে যাচ্ছে। সেখানে গোপনীয়তা রক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। এর ফলে ওর সমস্যাগুলো
অন্যরাও জেনে যাবে। এ প্রসঙ্গে লিমা জানায়, এ কিশোর-কিশোরী কর্নারে যদি পর্দা থাকত তাহলে ও সেবা নিতে পারত। লোকলজ্জার ভয়ে সেদিন সেবা না নিয়েই ফিরে আসতে হতো না। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নারীপক্ষ
ইয়ুথ অ্যালায়েন্সের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বরিশাল বিভাগের পাঁচটি জেলার সেবা কেন্দ্রগুলোতে কাজ করছে। এ প্রসঙ্গে নারীপক্ষের প্রকল্প পরিচালক সামিয়া আফরীন জানান,
কিশোর-কিশোরীরা সেবাকেন্দ্রগুলোতে সঠিক সেবা পাচ্ছে কিনা, সেবাকেন্দ্রগুলোর কী কী দুর্বলতা রয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করেন। প্রথম প্রথম কিশোর-কিশোরী কর্নারগুলোতে স্বাস্থ্যকর্মীরা নিয়মিত আসতেন না।
স্বাস্থ্যকর্মীদের কী কী দুর্বলতা রয়েছে তা আলোচনার মাধ্যমে স্থানীয় সহযোগিতায় সমাধান করেন। এখন স্বাস্থ্যকর্মীরা নিয়মিত সেবা প্রদান করছেন। তিনি আরও বলেন, ভোলার ওই কিশোর-কিশোরী কর্নারে পর্দা না
থাকার কারণে কিশোর-কিশোরীরা স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছেন না। বিষয়টি ভোলার পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ও জেলা প্রশাসককে অবগত করি। তারা উভয়ই জানান, তারা পর্দার ব্যবস্থা করে দেবেন।
পরবর্তীতে তাদের তহবিল থেকে পর্দা কিনে দেন। অ্যাডভোকেসি কর্মসূচির মাধ্যমে এভাবে সমস্যাগুলো কাটিয়ে কিশোর-কিশোরী কর্নারের অর্জনগুলো পাওয়া সম্ভব হয়েছে। অনেক সময় কিশোর-কিশোরীরা কিশোর-কিশোরী
কর্নারে সেবা নিতে অনীহা প্রকাশ করে। এর কারণ কিশোর-কিশোরী কর্নারে সেবাদানের সময়ের সঙ্গে কিশোর-কিশোরী ও যুবাদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সময় মিলে না। এর ফলে কিশোর-কিশোরীরা স্বাস্থ্যসেবা নিতে
পারছে না। এ প্রসঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা সমিতির পরিচালক প্রোগ্রাম ড. সঞ্জীব আহমেদ বলেন, এমনিতেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের শরীর সম্পর্কে উদাসীন। তারা কিশোর-কিশোরী কর্নারে গিয়ে
সেবা নিতে লজ্জাবোধ করে। তারা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে, কিশোর-কিশোরী কর্নারে গেলে তাদের শরীরের গোপন তথ্য অন্যরা জেনে যাবে। এর সঙ্গে আবার স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সময় না মেলার অজুহাতও রয়েছে। এ
ভ্রান্ত ধারণা থেকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের বের করে আনতে হবে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যেতে তাদের যাতে যাতায়াতের সমস্যা না হয় সেটিও দেখতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালক সাহান আরা
বানু, এনডিসির মতে, দক্ষ জনশক্তি বিনির্মাণে পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রজননস্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এবং নারী ও শিশুর প্রতি
সহিংসতা কমিয়ে আনতে কিশোরীদের পাশাপাশি কিশোর বা তরুণদেরও প্রজননস্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার থেকেও বাবা-মায়ের ভূমিকা সে ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। তিনি আরও বলেন,
সরকারের তরফ থেকে ইতোমধ্যে ৯০৩টি কিশোর-কিশোরী কর্নার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেগুলো বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয় করা গেলে আরও ভালোভাবে কাজ করবে। বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি কিশোর-কিশোরীদের
জীবন-দক্ষতা-মানোন্নয়নে ২১টি জেলায় ‘তারার মেলা’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তাদের একত্রিত করেছে। এখানে কিশোর-কিশোরী-যুবারা পত্রিকা, শিশুতোষ পত্রিকা, এসআরএইচআর বিষয়ক ম্যাগাজিন পড়ার সুযোগ
পাচ্ছে। ক্যারম বোর্ড খেলছে, টেলিভিশন দেখছে, নাচ-গান শিখছে এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। যুববান্ধব সেবা, যৌন এবং প্রজননস্বাস্থ্য শিক্ষাও প্রদান করা হচ্ছে। পাঠ্য বইয়ে শারীরিক শিক্ষা অধ্যায়টি
শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না। এ অধ্যায়টি শিক্ষকদের কাছে একটি ট্যাবু হয়ে গেছে। ফলে শিক্ষার্থীরা তথ্য পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষকদের এ ট্যাবু থেকে
বের করে আনতেই কাজ করছে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি। বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির পিও (ইয়ুথ) মাহমুদা নাসরীন ভুঁইয়ার মতে, ২০১২ সাল থেকে ৭০০ থেকে ১ হাজার শিক্ষককে সমন্বিত যৌনতা বিষয়ক
শিক্ষা দেয়া হয়। যাতে শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে কোনো ধরনের সংকোচ ছাড়াই পড়াতে সক্ষম হন। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শারীরিক শিক্ষা অধ্যায়ে যৌন শিক্ষা নিয়ে যে স্বাস্থ্য শিক্ষা রয়েছে, তা যাতে শ্রেণিতে
শিক্ষার্থীদের পাঠদান করান হয়, শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষকদের কাছে প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে সঠিক তথ্য পায়। শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তাদের বয়ঃসন্ধিকালীন শারীরিক
পরিবর্তনের অতি প্রয়োজনীয় এ বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাবে। এর ফলে তারা তাদের শরীর সম্পর্কেও সচেতন থাকবে। এছাড়া অন্যান্য বিষয়ের পরীক্ষার মতো এ অধ্যায় থেকেও সরাসরি প্রশ্ন রাখার প্রয়োজনীয়
পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষ থেকেই উপকৃত হতো বললেন বেসরকারি সংস্থা বন্ধু’র পিএমইএল কোর্ডিনেটর ড. মো. আবুল বারাকাত। বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা
সমিতির নির্বাহী পরিচালক খোন্দকার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের মতে, কিশোর-কিশোরীদের মনে তাদের শরীর সম্পর্কে যে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা শিক্ষকরা সমন্বিত যৌনতা বিষয়ক শিক্ষা পাঠদানের মাধ্যমে দূর
করতে পারেন। অথচ শিক্ষকরা লজ্জার অজুহাতে এ পাঠদান থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু তাদের ছাত্রটি যখন একজন ধর্ষক বা কিশোর গ্যাংয়ের লিডার হিসেবে সমাজে পরিচিত হয় তখন তারা লজ্জাবোধ করেন না। একটি সুস্থ
সমাজ গড়ে তুলতে শিক্ষকদের এ বিষয়ে পাঠদানেও গুরুত্ব দিতে হবে।