
‘বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই’
- Select a language for the TTS:
- Bangla Bangladesh
- Bangla Bangladesh Male
- Bangla India Female
- Bangla India Male
- Language selected: (auto detect) - BN
Play all audios:

খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী হাশেম খান ১৯৪১ সালের ১ জুলাই চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার সেকদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। চাঁদপুরের হাসান আলী হাইস্কুল থেকে ১৯৫৬ সালে মেট্রিক পাস করেন। ভর্তি হন তৎকালীন
গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে (বর্তমান চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। ১৯৬১ সালে চিত্রকলায় প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬১-১৯৬৩ পর্যন্ত এশিয়া ফাউন্ডেশনের বৃত্তিতে মৃৎশিল্পে
রিসার্চ স্কলার হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের প্রাচ্যকলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধান গ্রন্থ
অলংকরণের প্রধান শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৭৯ সালে জাপানের টোকিওতে শিশু পুস্তক চিত্রণে স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। তিনি চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পদক লাভ
করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: জুননু রাইন যুগান্তর: বিশ্বায়নের একটা অস্বাভাবিক গতি দ্বারা মানুষ পরিচালিত হচ্ছে। মনের ঐশ্বর্যের দিক দিয়ে নয়, মানুষ বরং আর্থিকভাবে বড় হওয়ার প্রবল প্রতিযোগিতায় মগ্ন।
এ প্রতিযোগিতায় ছুটতে ছুটতে মানুষ বাঁচতেও ভুলে গেছে। এই দৃশ্য আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বেশি চোখে পড়লেও, সারা পৃথিবীই কমবেশি এভাবে এগোচ্ছে। এমন একটা ভবিষ্যৎ দুনিয়ায় শিল্প তার প্রয়োজনীয়তা
কীভাবে বজায় রাখতে পারবে? হাশেম খান: বিশ্বায়নের ‘অস্বাভাবিক গতি’র বিষয়টি মানবসভ্যতার বিকাশের শুরু থেকেই অর্থাৎ হাজার হাজার বছর ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন পরিবেশে মানুষ, সমাজ,
সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ধর্ম নির্বিশেষে বিদ্যমান ছিল, বিদ্যমান রয়েছে- বিদ্যমান থাকবেও। তবে বিষয়টিকে যথাযথভাবে অনুধাবন করে মানুষ এগোচ্ছে। উন্নত দেশ আরও উন্নত (?) হচ্ছে এবং উন্নয়নশীল দেশ ও পিছিয়ে
থাকা দেশও উত্তরণের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে (?) থাকার চেষ্টায় কৌশলে অপকৌশলে কাজ করে চলেছে। এত সব কিছুর মধ্যে শিল্পকলা সংস্কৃতি তথা সভ্যতা নিজস্ব চেহারায় নির্ণীত হচ্ছে। যুগান্তর: বাংলাদেশের জেলায়
জেলায় শিল্পকলা একাডেমি আছে, পরিত্যক্ত এবং ব্যাপক অবহেলার শিকার এসব প্রতিষ্ঠান শিল্পের বিকাশে পর্যাপ্ত কাজ করতে পারছে? শিল্পচর্চায় শিল্পকলা একাডেমির মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ করার
ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অন্তরায় এবং সম্ভাবনাগুলো জানতে চাই। হাশেম খান: বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের একদম শুরুতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ‘শিল্পকলা আইন’
প্রণয়নের মাধ্যমে ঢাকায় ও জেলায় জেলায় শিল্পকলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন দেশের চেতনায় বাংলাদেশের শিল্পকলা ও সংস্কৃতির যথাযথ বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। এ বিশাল ও মহৎ কাজটি তার অকস্মাৎ মৃত্যু,
তথা হত্যার কারণে যথাযথ পরিকল্পনাকে বাদ দিয়ে ক্ষমতা দখলকারী মুক্তিযুদ্ধ চেতনাবিরোধীদের হাতে পড়ে শিল্পকলা একাডেমি কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। অনেক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ১৯৯৬ সালে
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দেশ শাসনে এসেও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, সোনারগাঁ-বাংলাদেশ লোকশিল্প জাদুঘরসহ বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বিকাশ লাভ করা
দূরের কথা যা আমাদের সম্পদ হিসেবে দীর্ঘদিন বিবেচিত ছিল তাও রক্ষা করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। জাতীয় জাদুঘরে বহু মূল্যবান সংগ্রহ, সম্পদ, অবহেলা অযতেœ ও শিক্ষার অভাবে দিনে দিনে নষ্ট হচ্ছে।
দীর্ঘকাল ধরে অপ্রতুল বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা নেয়ার মানসিকতা না থাকায় প্রতœতাত্ত্বিক বস্তুসামগ্রী, দুর্লভ শিল্পকলা, ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। জাতীয় জাদুঘরের কার্যক্রম ট্রাস্টি বোর্ডের
অনুমোদন ক্রমে পরিচালিত হওয়ার আইন থাকলেও দীর্ঘকাল ধরে মহাপরিচালক পদে সরকারি কর্মকর্তারা যারা এসেছেন তাদের বেশিরভাগই ট্রাস্টি বোর্ডের সিদ্ধান্তগুলো অবহেলা করে নানা অজুহাতে মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী
ও ঊর্ধ্বতন সচিবদের খুশি রাখার কাজেই বেশি ব্যস্ত থেকেছেন। আমলারা সবাই তা করেছেন এটাও ঠিক নয়। হঠাৎ-ই দু-একজন যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক
জটিলতায় তারাও একঘরে হয়ে তাদের নির্ধারিত সময় পার করেছেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং বিভিন্ন জেলায় জাদুঘর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, (সোনারগাঁ) বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আমলাতান্ত্রিক
কঠিন নিয়মের মধ্যে থেকে সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ হয়ে আসছে। এসব প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘমেয়াদি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা ও গবেষণা একেবারেই অবহেলিত। কর্তাব্যক্তিরা পরিকল্পনা ও গবেষণার কথা শুনলে ভ্রু
কুঁচকান- সে সবকে তারা অপচয় মনে করেন। যে জন্য উপরোক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন দিবস পালনের ও বিচিত্র সব অনুষ্ঠান পালনের প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে সুদূরপ্রসারী
পরিকল্পনা ও গবেষণা যে তরুণ সংস্কৃতিসেবীদের প্রেরণা ও উৎসাহ জোগাতে পারে সে বিষয়টির গুরুত্ব আজকাল সংশ্লিষ্টরা অনেকেই বুঝতে চান না। এশিয়ান বিয়েন্যাল-দু’বছর পর গত চল্লিশ বছর ধরে নিয়মিতভাবে হয়ে
আসছে- শিল্পকলায়। প্রতিবারই সময়ের দাবিতে কিছু কিছু পরিবর্তন ও নতুন যোগ হলেও ৪০ বছরের মধ্যে যে আরও অনেক কিছু হতে পারত সে বিষয়ে বর্তমান প্রযুক্তি দ্রুত পরিবর্তনের ধারাকে মনে রেখে, শিল্পকলা,
থিয়েটার বিষয়ে সঙ্গীত বিষয়ে, চলচ্চিত্র ও অন্যান্য শিল্পকলার প্রসারে তরুণ ও আগামী প্রজন্মের শিল্পীদের প্রেরণা ও উৎসাহী করার জন্য গবেষণালব্ধ পরিকল্পনা বর্তমানে অতিজরুরি। নতুন প্রজন্মের জন্য
প্রাণোদনা সৃষ্টি করতে না পারলে সব কিছুই স্থবির হয়ে যাবে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিচালনা বোর্ড, ট্রাস্ট বোর্ড বিভিন্ন বিষয়ে মেধাবী ও সৃজনশীল ব্যক্তিত্বদের
বিষয়ভিত্তিক শিল্পী ও গবেষকদের প্রাধান্য বাড়াতে হবে। সরকারি ও মন্ত্রণালয়ের আমলাদের আধিক্য কমাতে হবে। যুগান্তর: আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত হওয়ার রসদ বেশি না শুধু পাস করার রসদ বেশি?
শিক্ষাব্যবস্থায় কী ধরনের পরিবর্তন ইতিবাচক ফল আনতে পারে? এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ হাশেম খান: স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি এসে বলতে বাধ্য হচ্ছি- বর্তমান আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা একটা হযবরল
অবস্থা। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকদের জন্য সার্বজনীন সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা, আজও তৈরি হয়নি। জিপিএ-ফাইভ, জিপিএ-ফোর; এসব ফল ও ডিগ্রি লাভের জন্য লেখাপড়া করে। কবে দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যাবে সে
চিন্তায় বিভোর। বর্তমানের নানা রকম শিক্ষাব্যবস্থায় আরবি, ইংরেজি মাদ্রাসা শিক্ষা, বিভিন্ন কিসিমের চটকদার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুযোগ কম। মানুষকে নিয়ে
ভাবার সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা, স্বাধীনতার চেতনা এ সবের প্রতি আগ্রহ ও প্রেরণা পায় না। কারণ- অনেক বিষয়, পরীক্ষার পর পরীক্ষা, পিঠে করে নিয়ে যেতে হয় ছাত্রের ওজনের থেকেও ভারী সব বই
খাতা- প্রতিদিন তাকে বহন করে নিতে হয়- যা অমানবিক ও অযৌক্তিক। খেলাধুলা ও আনন্দে সময় কাটানোর ছাত্রদের সুযোগে শিক্ষাব্যবস্থায় নেই। কারণ স্কুল থেকে ফিরেই তাকে একে একে সব বিষয়ে কোচিং নেয়ার জন্য
নাভিশ্বাস ছোটাছুটি করতে হয়। আশার বিষয় বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক ও শিশু-কিশোরদের স্কুলগুলোকে আনন্দ নিকেতনে পরিণত করার জন্য ধীরে ধীরে অনেক
পদক্ষেপ নিয়েছেন। জানুয়ারির ১ তারিখ সমগ্র দেশের শিশুরা একই সঙ্গে নতুন বই হাতে পাচ্ছে এটি নিঃসন্দেহে স্বাধীন দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিশাল অর্জন। ‘পরীক্ষা’ নামক দানবের হাত থেকে কোমলমতি শিশুদের
রক্ষা করতে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়েছে। যদিও আমরা বলেছিলাম প্রাথমিক স্তর পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিশুরা পরীক্ষা না দিয়ে পড়ার সুযোগ পাক। এ সহজ উপায়টিতে শিশুরা মনের আনন্দে পাঁচ
বছর পড়তে পারবে। সমগ্র দেশে এভাবে কয়েক বছরেই সার্বজনীন শিক্ষা ছড়িয়ে যাবে। কেউ আর নিরক্ষর থাকবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্কুলে শিশু-কিশোরদের সকালে ও দুপুরে পুষ্টিকর খাবারেরও ব্যবস্থা করেছেন।
যা ইতিবাচক বিষয়। যুগান্তর: স্কুল পর্যায়ে শিল্পবিষয়ক যে চারু ও কারুকলা বিভাগ ছিল, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা তা একেবারেই গুরুত্বহীনভাবে রেখেছে। কেউ চাইলে পড়তে পারে নাও পড়তে পারে; ফাইনাল পরীক্ষায়
এর মার্কও যুক্ত হয় না। এ রকম একটি সীদ্ধান্ত সংস্কৃতিমনা বাঙালি জাতির ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে? হাশেম খান: বেশ কিছু গবেষণা ও পরিকল্পনা করে চারু ও কারুকলা বিষয়টি স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত
আবশ্যিক বিষয় করা হয়েছিল। ছবি আঁকার জন্য কোনো কোচিংয়ের প্রয়োজন হয় না। শিশুরা মনের আনন্দে ছবি আঁকার মাধ্যমে তাদের স্বপ্নগুলো রং রেখায় তুলে ধরে। যে সব বিষয় আঁকে সে সব বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা
জন্মে। গাছপালা, নদী, মাঠ, চেনা জগতের মানুষ, পশু-পাখিসহ অনেক কিছু। ছবি আঁকার মাধ্যমে অল্প বয়স থেকেই শিশুর পারিমিতি বোধ চর্চা হয়- নিজের সব কাজ সুন্দরভাবে সমাধান করার চেষ্টা হয়, শিশু,
স্বাবলম্বী হয়, সাহসী হয়। ছবি আঁকতে পেরে বা নিজের ইচ্ছামতো কোনো শিল্পকর্ম তৈরি করে নিজে যেমন আনন্দ লাভ করে অন্যদেরও আনন্দ দিয়ে বলে দেখ, আমি সুন্দর অনেক কিছু করতে পারি। অর্থাৎ ‘আমিও পরি।’
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চারু ও কারুকলার পাঠ্যসূচিকে এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে কোনো কিশোর যদি অষ্টম শ্রেণির পর লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় তবে চারু ও কারুকলাকে তার পেশা হিসেবে গ্রহণ করে
জীবনযাপন করতে পারে। তাই আমি মনে করি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি বিবেচনায় এনে পরীক্ষা নেয়া ও নম্বর দেয়ার ব্যবস্থা করে এ শিক্ষাকে যথাযথ অবস্থায় অনতিবিলম্বে ফিরিয়ে আনবে। নম্বর না পেলে বিষয়টি কোনো
গুরুত্বই পাবে না। যুগান্তর: এখনকার বেশিরভাগ শিল্পীরা তাদের আর্ট ওয়ার্কে প্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে থাকেন। কর্পোরেট জগতে গ্রাফিক্স আর্টের ব্যবহার অনেক বেড়েছে, শিল্পীর এ প্রযুক্তির অংশগ্রহণ
শিল্পের কাজে কতটুকু সুফল বা কুফল আনতে পারে? হাশেম খান: প্রযুক্তির বিকাশ ও পরিবর্তন সারা বিশ্বেই দ্রুত ঘটে যাচ্ছে। চিত্রশিল্পীরা অবশ্যই প্রযুক্তিকে নিজের আয়ত্বে এনে তার শিল্পকর্মকে নতুন নতুন
বিন্যাসে সৃষ্টি করার মেধাকে কাজে লাগাবে। শিল্প কখনও প্রযুক্তির দাস হবে না। যুগান্তর: ইলাস্ট্রেশনের পাইওনিয়র বলা হয় আপনাকে। ইলাস্ট্রেশনও যে মূলধারার শিল্প সেটা বাংলাদেশে আপনি দেখিয়েছেন।
ইলাস্ট্রেশন নিয়ে অনেক কাজ আছে আপনার। অনেকগুলো আন্তর্জাতিক ওয়ার্কশপও করেছেন। আর্টের এ মাধ্যমটির বর্তমান অবস্থা এবং বাংলাদেশে এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাই হাশেম খান: অন্যান্য সৃজনশীল
শিল্পকলার মতোই ইলাস্ট্রেশনও মূলধারার শিল্পকলা। কিন্তু অদ্ভুত কোনো কারণে- সম্ভবত অজ্ঞতার কারণেই বাংলাদেশে ইলাস্ট্রেশন শিল্পীদের বাঁকা চোখে দেখা হয়। কিন্তু এটা এখন আর ধোপে টিকবে না। বাংলাদেশের
৩ জন শিল্পী- কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী এবং আমি নিজে সফলভাবে ইলাস্ট্রেশন যেমন করেছি তেমনই চিত্রকলা, প্রিন্ট মেকিং ভাস্কর্য নানাবিধ কাজে স্বাক্ষর রেখেছি। স্লোভানিয়ার এখন খ্যাতিমান গ্রাফিক
শিল্পী ইলাস্ট্রেটর প্রফেসর ব্রনোস্কি একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমার দেশের ইলাস্ট্রেটর ও চিত্রশিল্পীদের বিভাজন ও ইলাস্ট্রেটরদের অন্য চোখে দেখার বিষয়ে আমার আলোচনার জবাবে মজা করে বলেছিলেন- তুমি
ইলাস্ট্রেশন জান এবং অন্যান্য শিল্পকর্মেও অনায়াসে তোমার বিচরণ। যারা তোমাকে ইলাস্ট্রেটর হিসেবে হেয়প্রতিপন্ন করতে চায় তারা দু-একখানা ছবি আঁকতে পারলেও ইলাস্ট্রেশন কিন্তু করতে পারে না।
প্রকারান্তরে তুমি যে তাদের চেয়ে গুণী শিল্পী সেটিই প্রকাশ পায়। যুগান্তর: আপনারা ড্রইং বেজড রিয়েলেস্টিক ইলাস্ট্রেশনে শুরু করেছিলেন, আর এখন সেই অর্থে ইলাস্ট্রেশন নেই বললেই চলে। যা আছে তাও
গ্রাফিক্স বেজড। এ গ্রাফিক্স বেজড ইলাস্ট্রেশন কতটা শিল্প ধারণে সক্ষম? হাশেম খান: বিষয়টি শিল্পীর নিজের বিষয়- তিনি কীভাবে, কোন মাধ্যমে এবং কোন আঙ্গিকে ইলাস্ট্রেশন করবেন। গ্রাফিক বেজড
ইলাস্ট্রেশনও নতুন কিছু মাত্রা নিয়ে আসতে পারে। যুগান্তর: আপনার কাজে পাখি, নদী, গ্রাম, ফসলের মাঠ এবং গ্রামারের জীবনই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। সরকার উন্নয়নের স্বার্থে গ্রামকে শহর বানানোকে
প্রাধ্যান্য দিচ্ছে। যদি সেটা হয়, তাহলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া আশঙ্কা থাকবে। আপনার কাজে যে বিষয়গুলো এসেছে সেগুলো হুমকির মুখে পড়তে পারে। আমরা যে সবুজ শ্যামল বাংলাদেশের কথা বলি হয়তো তখন
আর এর অর্থ পুরোপুরি থাকবে না। সরকারের এ চিন্তা কি দেশের জন্য ভালো হওয়ার সুযোগ আছে? এ বিষয়ে শিল্পী এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার মতামত জানতে চাই হাশেম খান: গ্রাম কখনও নষ্ট করা যাবে না।
গ্রামকে শহর বানানোর বিষয়টা আমি যতটুকু বুঝি শহরের মতো গ্রামের মানুষের জন্য বিদ্যুৎ, সুপেয় পনি গ্যাস ইত্যাদি ব্যবহারের সুযোগের ব্যবস্থা করা। রাস্তাঘাট ও যাতায়াতে শহরের মতো সুবিধা দিতে হবে। একই
সঙ্গে স্কুল, কলেজ, খেলাধুলার ব্যবস্থা ও হাসপাতাল, মাতৃসদন তথা চিকিৎসাব্যবস্থা রেখে আধুনিক জীবনযাপনের সুযোগ গড়ে তুলতে হবে। গ্রামের গাছপালা, সবুজ বনায়ন, কৃষি জমি, নদী খাল যথাযথভাবে সংরক্ষণের
ব্যবস্থা করে কৃষি উৎপাদন ও কুটিরশিল্প তৈরির জন্য আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। পরিবেশ নষ্ট হয়, এমন সব কলকাখানা স্থাপনা থেকে গ্রামকে দূরে রাখতে হবে। যুগান্তর: আপনার একটা সাক্ষাৎকারে
বলেছেন, ‘যে কোনো সুন্দরীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে ভালোবাসি’ আপনার দৃষ্টিতে সুন্দরের ব্যাখ্যা কী? বিশেষ করে নারীর সৌন্দর্যকে আপনি কীভাবে বিচার করেন? হাশেম খান: গায়ের রং ফর্সা, চলনে-বলনে চৌকস,
আধুনিক সাজসজ্জা হলেই আমার কাছে সুন্দর নয়। সহজ, সরল, স্বাভাবিক মনের মানুষ, যিনি সজ্জিত রুচির, শালীনতা বোধ যার আছে এবং মানবিক গুণের অধিকারী তিনিই বেশি সুন্দর। গায়ের রং কালো হলেও চেহারা
সাদামাটা ও হাস্যোজ্জ্বল হলেও আমার কাছে আকর্ষণীয়। যুগান্তর: আপনার প্রিয় দুটো বই; যা পাঠকদের পড়তে পরামর্শ দেবেন হাশেম খান: সারা জীবনে এত বই পড়েছি- তার থেকে শুধু দুটি বই বেছে নেয়া আমার পক্ষে
অসম্ভব। বিষয়, চমৎকার গদ্য, পরিবেশনা ইত্যাদি কারণে অনেক বই-ই আমার প্রিয়। পাঠকদের বলব- বই পড়ুন, বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন, বইয়ের মতো ভালো বন্ধু আর নেই। প্রিয় মানুষকে বই উপহার দিন। যুগান্তর:
শিল্পী না হলে কী হতেন? হাশেম খান: শিল্পী না হলে শিল্পীই হতাম। চিত্রশিল্পী না হলে সঙ্গীতের জগতে ঢুকে যেতাম। একজন চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছা ছোটবেলায় ভেবেছিলাম। চিকিৎসকরাও এক ধরনের শিল্পী, মানবতার
সেবা করে যাচ্ছেন। লেখালেখির অভ্যাস বা নেশা ছোটবেলা থেকেই ছিল। কিন্তু একজন লেখক হওয়ার জন্য যে পরিমাণ সময় দিতে হয় তা চিত্রকলা চর্চার কারণে দিতে পারিনি। তারপরও ১৯-২০টি বই বের হয়েছে।